23 December, 2015

ভালবাসার গল্প ০৩

আয়নার সামনে অনেক্ষণ দাড়িয়ে আছি।আজকে বিকেলের ঘটনাটাই কেবল মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।কি হতে কি হয়ে গেল?আর কিছু ভাবতে পারছিনা।দরজায় ঠক ঠক শব্দ শুনে একরাশ বিরক্তি নিয়ে দরজা খুললাম।দরজার সামনে দাড়ানো লোকটাকে দেখে বিরক্তির পরিমাণ আরও কয়েক স্কেল বেড়ে গেলো।
-কে আপনি?
--মানে?
--মানে আপনি কে?
--আমি অন্তিম
--অন্তিম?কিসের অন্তিম?কোন অন্তিম?এখানে কি চাই?
--মানে?তুমি কি আমার উপর রেগে আছো?
--আমি অপরিচিত কারও উপর রাগ করিনা।
--পরিচিত হয়ে নেই তাহলে?ভেতরে তো আসতে দিবা?
--ভেতরে আসবেন কেন?কোন দরকার নাই।আমার রুমে আমি আপনাকে আসতে দিবোনা।
--প্যাঁচাল করবানা বুঝছো?ঘুম আসতেছে অনেক।দরজার সামনে থেকে সরো।
-আমাকে এক প্রকার সরিয়েই রুমে ঢুকে পড়লো লোকটা।এতো বড় সাহস তার!কিছুতেই একে সহ্য করা যাবেনা।ওর আচার আচরণ দেখে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না।আমার রুমে এসে এমন ভাব ধরছে যেন ওর নিজের রুম আর ও এই রুমেই প্রতিদিন ঘুমায়।বিছানায় বসে কর্নারে রাখা আমার ছবিটা হাতে নিয়ে দেখছিলো।আমি তখনো দরজার কাছেই দাড়িয়ে আছি।
--ওখানেই দাড়িয়ে থাকবা নাকি ঘুমাবা নাকি…?
-কিসের নাকি?হ্যা?বের হয়ে যান আমার ঘর থেকে।কোন সাহসে আমার রুমে ঢুকেছেন?আমি আমার রুমে কোন ছেলেকে এলাউ করবোনা
--হ্যাঁ?মেয়েকে এলাউ করো?তুমি কি অন্য কিছু নাকি?
--একদম ফালতু কথা বলবেননা।আপনি বের হোন তো।
--আজিব!আমি থাকবো কোথায়?
--কেন?আগে কোথায় থাকতেন?নিজের বাসা নেই?সেখানে গিয়ে থাকেন
--আগের কথা বাদ দাও।আমি না তোমার হাজব্যান্ড?বিয়ের পর হাজব্যান্ড ওয়াইফ তো একই রুমেই
--বিয়ের পর হাজব্যান্ড ওয়াইফ এক ঘরে থাকবে এই নিয়ম কই পাইছেন আপনি?
--ডাকবো তোমার আব্বুকে?বলবো তুমি আমায় বিয়ের প্রথম রাতেই ঘর থেকে বের করে দিচ্ছো?
-.-
-শয়তান লোকটা বাবার ভয় দেখিয়ে আমাকে থামিয়ে দিলো।বাবাকে আমি ভয় পাইনা তবে অনেক ভালোবাসি।আর তাই বাবার কথায় এই শয়তান লোককে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি।কয়দিন আগেও অন্তিম আমাকে দেখলে ভয়ে চুপসে যেতো অথচ আজকে বিয়ে হতে না হতেই যেন ওর সাহস এক লাফে আসমানে উঠে গেছে।আমাকে পাত্তাই দিচ্ছেনা।বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে শুয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো
--দরজাটা বন্ধ করে লাইট টা নিভিয়ে দাও
--কেন?
--আজিব!লাইট জ্বালিয়ে কিভাবে?ধুরর…চলে আসো
-কি বলতে চাচ্ছেন কি আপনি?আমি আপনার সাথে এক বিছানায় কিছুতেই ঘুমাতে পারবোনা
--তো?কি করতে পারবা তুমি আমার সাথে? (লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসলো লোকটা,তার চোখে শয়তানি চিন্তা চিক চিক করছে)
--আব্বুউউ,কি দোষ করলাম যে এই রকম একজনের সাথে আমার বিয়ে দিলা?
--ওকে ওকে,ঢং করে আর কাঁদতে হবেনা।আমি ঘুমিয়ে পড়ছি।তুমি ফ্লোরে শুয়ে পইরো কেমন?গুড নাইট
-.-
-ভালোবাসা,প্রেম,বিয়ে এইসব নিয়ে আমি কখনো ভাবিনি।কিন্তু এইভাবে হঠাৎ করে আমার বিয়ে হয়ে যাবে তাও এই রকম একটা অসহ্য লোকের সাথে তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।সব আব্বু আম্মুর দোষ।
-.-
-আব্বু আম্মু ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন।কিন্তু খুব বেশিদিন একসাথে থাকতে পারেননি।অভিমান করে একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে গেলেন মাঝখানে আমি ভাঙা সেতুর ন্যায় ঝুলছিলাম।
-.-
-প্রথম আঠারো বছর আমি মায়ের সাথেই ছিলাম।
-বুঝতে শেখার পর থেকেই আমি বারবার দুজনকে এক করার চেষ্টা করে আসছি কিন্তু তারা কেউই কারও সাথে থাকতে রাজি নন।সেবার বাবা রাজি হয়েছিলেন কিন্তু মা রাজি হননি আর সেদিনের পর থেকে গত তিনবছর ধরে আমি বাবার সাথেই আছি আর বাবার প্রতি ভালোবাসা এতো বেড়েছে যে তার কোন কথাই ফেলতে পারিনা।
-অন্তিমের সাথে আমার বিয়ের ব্যাপারটাও এই কারনেই ঘটেছে।আম্মু আব্বুকে না জানিয়ে আমার বিয়ে ঠিক করেছিলেন আর আব্বু আম্মুকে না জানিয়ে হঠাৎ করেই অন্তিমের সাথে আমার বিয়েই দিয়ে দেন।
-.-
-অন্তিমের সাথে আমার প্রথম দেখাটা একেবারেই শুভ হয়নি।সেদিন বাবামায়ের বাইশতম বিবাহ বার্ষিকী ছিলো।প্রতি বছরের মতো সেদিনও হাতে একটা বক্স নিয়ে আব্বুর অফিসে গেলাম।আম্মু আব্বুর অফিসে জব করতো বলে তাদের দুজনকে একসাথে এখানেই পেতাম।
-.-
-এক হাতে বক্স আর এক হাত দিয়ে আব্বুর রুমের দরজা খুলে ভেতরে পা দিতেই কিছু একটা অনুভব হলো।বুঝতে পারলাম আমি কারও সাথে ধাক্কা খেয়েছি আর আমার হাত থেকে বক্সটা নিচে পড়ে গেছে।আব্বুর রুম থেকে বের হওয়া লোকটা যার সাথে আমার ধাক্কা লেগেছিলো সে তখনো আমার সামনেই দাড়িয়ে আছে।একে আগে কখনো অফিসে দেখিনি।
-.-
-লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে ফ্লোরে পড়ে থাকা বক্সটা আস্তে আস্তে খুলে আবার সাথে সাথেই বন্ধ করে দিলাম।তারপর অসহায়ের মতো ফ্লোরে বসে পড়লাম।আমি তখনো ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছি আর সেও আমার দিকে তাকিয়ে আছে।সম্ভবত ও আমার চোখের ভাষা বুঝতে পারছিলোনা।বাজ পড়ার আগে আকাশ যেমন থমকে যায় আমিও এতক্ষণ সেইরকম থমকে ছিলাম।ও আমাকে বললো
--ইক্সকিউজমি,কি হয়েছে আপনার?
--আব্বুউউউউউউউউউ…
-.-
-আমার চিৎকারে অফিসে মোটামুটি একটা ছোট খাট ভূমিকম্পের মতো অনুভূত হলো।চিৎকার শুনে আব্বু,আম্মু অফিসের আরও লোকজন ছুটে এলো।
--কি হয়েছে নীলা?চিৎকার করছিস কেন?
--আব্বু আমি এতো কষ্ট করে তোমাদের জন্য নিজের হাতে কেক বানিয়ে আনলাম,এই প্রথম বার আব্বু আমি নিজের হাতে কেক বানিয়েছি আর এই লোকটা সেই কেকটা ভেঙে ফেললো।আব্বু এবার কি হবে?তোমরা এনিভার্সারি সেলিব্রেট করবা কিভাবে?আমি ভেবেছি আজকে তোমাদের দুজনকে নিয়ে ঘুরতে যাবো কিন্তু এই লোকটা সব শেষ করে দিলো আব্বু ,সব শেষ করে দিলো।
--এর জন্য কাঁদতে হয়?আমি আর একটা কেক কিনে আনতে বলছি আর কেক না কাটলে কি বাইরে ঘুরতে যাওয়া যায়না?
--কিন্তু আব্বু ওটা আমি নিজে বানিয়েছি।আর শুরুতেই যখন সব ভেঙে গেলো তখন আমি আর কোথাও ঘুরতে যাবোনা।
-.-
-আব্বু আমাকে উঠিয়ে উনার রুমে নিয়ে গেলেন।আম্মু আর ওই গুন্ডা লোকটাও ভেতরে আসলো।সে এমন ভাব ধরছে যেন কিছুই বুঝতে পারেনা সে।আব্বু তাকে বললো
--অন্তিম,নীলাকে এসে সরি বলো তারপর বাইরে থেকে একটা বড় কেক নিয়ে এসো।-
-.-
-সরি বলার সময় আমি অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম।
-রাগ কমানোর জন্য টেবিলের উপর রাখা টিস্যু বক্স থেকে একে একে টিস্যু বের করে ছিড়ছিলাম।কিন্তু কিছুতেই রাগ কমছিলোনা।আমার ইচ্ছে করছিলো ওই অন্তিম্মার মাথার সব চুল একটা একটা করে ছিড়ে ফেলতে।অথচ আজ কিনা সেই ছেলের সাথেই আমার বিয়ে হলো আর সেই মনে হচ্ছে আমাকে পাগল বানিয়ে আমার মাথার সব চুল উঠে যাওয়া ব্যবস্থা করছে।
-.-
-বিয়ের দিন আরও জানতে পারলাম অন্তিম খালি বাবার অফিসের স্টাফই না বাবার সাথে ওর আগে থেকেই আত্মীয়তার সম্পর্ক।বাবার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে অন্তিম।সেই হিসেবে অন্তিম আমারও চাচাতো ভাই।সেই হিসেবে আমার মায়ের শ্বশুরবাড়ি আর আমার শ্বশুরবাড়ি একই বাড়ি।আবার আমার নিজের বাড়িই আমার শ্বশুরবাড়ি।কেমন যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছে।গুলিয়ে গেলে চলবেনা।এর সাথে একই ঘরে থাকা সম্ভব না।একে এ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে তার আগের আপন ঠিকানা বস্তিমার্কা মেসেই পাঠাতে হবে
-.-
-দিন দিন এর অত্যাচার যেন বেড়েই চলছিলো।আসতে যেতে,উঠতে বসতে আমাকে খোঁচাতেই ব্যাস্ত ছিলো ও।আমাকে না রাগালে যেন ওর শান্তি হয়না।সেদিন বলে আমার নীলাদ্রী নাম নাকি ওর একদম পছন্দ না।আবার নীলা নামটাও নাকি বেশ কমন লাগে ওর কাছে।
--আমি কিন্তু তোমাকে নীল বলেই ডাকবো
--নীল ছেলেদের নাম
--সমস্যা নেই।আমার ভালো লাগে।
--আপনার ভালোলাগা দিয়ে আমার কিছু যায় আসেনা
--তাইলে বউ ডাকি?আমাদের তো আর ছেলেমেয়ে নাই যে তাদের মা বলে ডাকবো
--আপনি প্লিজ আমাকে কিচ্ছু ডাকবেননা
--তোমার এই ফিলাদ্রী না নীলাদ্রী এই নাম তোমার আম্মু রাখছে তাইনা?
--আপনি কিভাবে জানেন?
--কারণ এইসব উদ্ভট নাম তোমার মায়ের মাথায়ই আসে।
--মানে?
--মানে আমার জন্মের পর আমার বাবা তোমার বাবাকে বললেন আমার নাম বেছে দিতে আর তোমার বাবা করলেন কি?তার প্রেমিকা মানে তোমার মা মানে আমার শ্বাশুড়ী আম্মার কথা অনুযায়ী আমার নাম রাখলেন খুন্তি মানে অন্তিম।তুমি জানো ছোটবেলায় পোলাপাইন আমাকে খুন্তি ডাকতো?
--তাইতো বলি আপনি মানুষ টা এতো বদ কিন্তু আপনার নাম এতো সুন্দর কেন?
--শ্বাশুড়ী আম্মা আগে আমাকে অনেক স্নেহ করতো।লাঞ্চ করার সময় ডাক দিতো অথচ তোমাকে বিয়ে করার পর থেকে আমার সাথে কথাই বলেনা।অফিসে যতোবার আমার সাথে দেখা হয় ততোবার সালাম দিয়ে বলি "ভালো আছেন আম্মা?" উনি রাগত স্বরে বলেন "আমাকে আম্মা ডাকবেনা"
-.-
-বিয়ের কিছুদিন পর বাবার কথামতো আমি আর অন্তিম ওদের বাড়িতে গেলাম।আমি ভেবেছিলাম আমার মায়ের সাথে যেমন হয়েছে আমার সাথেও সেইরকম কিছুই ঘটবে।কিন্তু আমার শ্বশুর,শ্বাশুড়ী,একমাত্র ননদ অন্তরা আমাকে মন থেকেই মেনে নিয়েছিলেন।উনাদের সাথে অল্পদিনেই আমার বেশ ভালো সম্পর্ক তৈরী হলো।
-সারাক্ষণ উনারা আমাকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।
-আমার মনেই হচ্ছিলোনা যে আমি এই বাড়ির বউ,মনে হচ্ছে যেন আমি এই বাড়ির অতিথি।
-.-
-গ্রামে প্রায় দশ বারোদিন থেকে আবার ঢাকায় ফিরে এসেছি।আসার সময় উনাদের সবার জোরাজুরিতে কথা দিয়ে এসেছি রোজার ঈদটা উনাদের সাথে গ্রামে কাটাবো।একদিন সকালে খাবার টেবিলে অন্তিম আব্বুকে বললো যে ও নাকি আমাদের জন্য আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে।পরের মাসেই আমাকে নিয়ে ঐ ফ্ল্যাটে উঠবে।বাবা প্রথমে অনেক আপত্তি করেছিলেন কিন্তু অন্তিম বললো ঘরজামাইয়ের মতো থাকতে ওর লজ্জা লাগছে তাই বাবাও রাজি হয়ে গেলেন।কিন্তু আমি কিছুতেই রাজি হলামনা।খাবার টেবিলেই চেঁচিয়ে উঠে বললাম "আমি বাবাকে ছেড়ে কোথাও যাবোনা।কারও যদি এখানে থাকতে সমস্যা হয় তাহলে সে অন্য জায়গায় গিয়ে থাকতে পারে।"
-অফিসে যাওয়ার সময় আমার কানের কাছে এসে ফিস ফিস করে বললো " তুমি যেখানে আমি সেখানে।তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছিনা আমি।
-আমার আত্মসম্মান এতো বেশিও না যে বউকে রেখে আলাদা থাকবো।"
-.-
-অন্তিমকে আমি এখনো বুঝতে পারলাম না।আসলে আমি ওকে কখনো বোঝার চেষ্টাই করিনি।মাঝে মাঝে ওকে আমার বেশ অদ্ভুত লাগতো।একদিন সকালে ঘুম ভাঙার পর দেখি আমার দুহাত ভরা কালো রঙের কাচের চুড়ি।আরেকদিন বিছানা থেকে নেমে হাটার সময় নুপুরের আওয়াজ শুনতে পেলাম,তাকিয়ে দেখি আমার পায়েই নুপুর পরানো।
-.-
-আমার পড়ার টেবিলের উপর কখনো ঠোঙায় ভর্তি বাদাম,কখনো বড়ই,কখনো আমলকি আবার কখনো ঝালমুড়ি দেখতে পেতাম।বুঝতে পারতাম এগুলো ও এনেছে কিন্তু আমি কখনো ছুয়েও দেখতাম না।
-.-
-প্রত্যেক বৃহস্পতিবার এলেই আমাকে বলতো
-"চলো কালকে মুভি দেখতে যাই।"
-"শপিং এ যাবা?ঐদিন একটা মলে কালো রঙের একটা শাড়ি দেখেছি।এত্তো সুন্দর ছিলো শাড়িটা।"
-"এই নীল,নতুন রাস্তায় হাটতে যাবা?ফুচকা খাওয়াবো তোমাকে"
-.-
-আমি কখনোই ওর এসব কথায় সাড়া দিতামনা।বরাবরের মতোই না বলে দিতাম।ও মন খারাপ করতো কিনা জানিনা তবে এতোবার মানা করার পরও বারবার আবদার করতো বলে আমিই বেশ বিরক্ত হতাম।আমি ভাবতাম কোথায় আমাকে প্লাটিনাম বা ডায়মন্ড গিফট করবে,র‍্যাডিসন নয়তো ওয়েস্টিনে ডিনারের কথা বলবে,না উনি আমাকে বলে "ফুচকা খাবা?"
-.-
-একদিন সন্ধ্যার পর বিছানায় শুয়ে শুয়ে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছি আর পেন্সিলের গোড়ায় কামড় দিচ্ছি।পড়ায় কিছুতেই মন বসাতে পারছিলাম না।হঠাৎ ফোনের ভাইব্রেশনে আমি নিজেই কেঁপে উঠলাম
--হ্যালো
--বউ
--কে?
--তোমার স্বামী,অন্তিম।তোমাকে না কতোবার বলছি আমার নাম্বার টা সেইভ করে রাখতে?
--আমি কারও আজাইরা নাম্বার ফোনে রাখিনা।ফোন দিছেন কেন?
--তুমি চিড়িং মাছ খাও?
--চিংড়ি মাছ?
--না,চিড়িং মাছ
--চিড়িং মাছ কি?
--তুমি চিনোনা?চিড়িং মাছ হলো এক ধরণের মাছ যা পানিতে থাকে
--আপনি এমন এক ধরণের মাছ নিয়ে আসেন যা বালিতে থাকে
--যাহ,বালিতে মাছ থাকে নাকি?শোনো,চিড়িং মাছ ছোট ছোট করে কেটে পেঁয়াজ মরিচ আরও হাবিজাবি দিয়ে কলাপাতায় পেঁচিয়ে চুলায় পুড়িয়ে খাওয়া হয়।উফফফ ভাবতেই আমার জিভে জল চলে আসছে
--তাই নাকি?আর একটু দেই?
--মজা নাও?তোমাদের বাসার ছাদে কলাগাছ আছে?
--নাই
--আচ্ছা আমি ম্যানেজ করে নেবো।
-.-
-বিয়ের পর থেকে আমি অফিসে গেলে অন্তিম আমাকে দেখে কখনোই দাড়াতোনা।অন্যরা বলতো
--আপনার তো বউ।না দাড়ালেও তো আর আপনার চাকরি খাবেনা
--সে পারেনা আমারে খেয়ে ফেলতে।আর চাকরি খেলেও কি?যোগ্যতা দেখিয়ে অন্যযায়গায় চাকরি পেয়ে যাবো।এখানে তো আর কেবল চাচার ভাতিজা বলেই বা আমার চেহারা দেখে আমাকে চাকরি দেয়নি।আমি যোগ্য ছিলাম তাই দিয়েছে।দেখেননা ছুটি লাগলেও দরখাস্ত দেই?
-.-
-ক্লাস শেষে অনেক্ষণ গাড়ির জন্য দাড়িয়ে আছি।ড্রাইভারকে কল করার জন্য ফোনটা হাতে নিতেই দেখি আব্বু কল করেছে।
--হ্যা আব্বু বলো
--তোর ক্লাস শেষ?
--হ্যা,এইতো গাড়ির জন্য দাড়িয়ে আছি
--শোন আমি একটু গ্রামে যাচ্ছি।আমার গাড়িটা গ্যারেজে তাই তোরটা নিয়ে যাচ্ছি
--আচ্ছা বাবা,সমস্যা নেই।আমি একটা রিক্সা নিয়ে চলে যাবো
--রিক্সা নিতে হবেনা,আমি অন্তিমকে বলে দিয়েছি ও তোকে নিতে আসবে
--বাবা অন্তিমকে বলার কি দরকার…
-.-
-কথা শেষ হওয়ার আগেই বাইকের পিপ পিপ শব্দ শুনতে পেলাম।সামনে তাকিয়ে দেখি অন্তিম দাড়িয়ে আছে।বিরক্তির ছাপ নিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি।অন্তিম হাতের ইশারা দিয়ে ডাক দিলো।
-.-
--এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলোতো?
--জঘন্য হতো।এইভাবে বাইক চালালে দশ বছর লেগে যাবে বাসায় পৌঁছাতে
--দশ মিনিটে বাসায় পৌঁছাতে চাও?তাহলে আমাকে ধরে বসো
--মাথা খারাপ নাকি আমার?
--আবারও বলছি আমাকে শক্ত করে ধরে বসো।পড়ে গেলে কিন্তু আবার তোমার বাবাকে বলতে পারবেনা যে আমি ফেলে দিয়েছি
-.-
-হঠাৎ ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে বাইকের স্পিড এতো বাড়িয়েছে যে আমি ওকে না ধরে বসলে পড়েই যেতাম সেদিন।
-.-
-আমাদের বিয়ের প্রায় চার মাস হয়ে গিয়েছে।অথচ তেমন কেউই বিয়ের কথা জানতোনা।তাই অনেকদিন ধরেই আব্বু একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমি বারবার না করে এসেছি।কিন্তু এবার আব্বু আমাকে না জানিয়েই অনুষ্ঠানের সব ব্যবস্থা করে ফেললেন।এর পেছনে যে অন্তিমের হাত আছে এই বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই।
-.-
-সকালে ঘুম ভাঙার পর আমার মনে হলো আমি কিছু একটার সাথে আটকে আছি।ঠিক মতো নড়াচড়া করতে পারছিনা।চোখ খুলে দেখি অন্তিম মুখ একদম আমার মুখের সামনে আর ও আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।অনেক্ষণ নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না।একটা ঘুমন্ত মানুষ কিভাবে এতো শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে পারে?আঙুল দিয়ে ওর এক চোখের পাতা উল্টালাম।ও চোখের পাতা একটু কাঁপিয়ে আবার বন্ধ করে ফেলল।দুচোখ মেলে বললো
-নীল?তুমি আমায় জড়িয়ে ধরেছো?সত্যি?নাকি স্বপ্ন?
--আমি আপনাকে ধরেছি নাকি আপনি আমাকে?
--যেই ধরিনা কেন?একবার যখন আমার কাছে এসেই পড়েছো তখন কিছুক্ষণ থাকো
--ইম্পসিবল।ছাড়েন বলতেছি আমারে
--একটা শর্ত
--কী?
--চোখ বন্ধ করো
--কেন?
--না করলে নাই।
-.-
-দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো ও।আমি গালে হাত দিয়ে বিছানায় বসে রইলাম।ঠিক এই মাত্র কি ঘটলো কেন ঘটলো কিছুই বুঝলাম না।
-.-
-বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা নেমে এলো।একটু পরেই গেস্টরা সবাই এসে পড়বে।আমি সকালের মতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বিছানায় বসে আছি।অন্তিম আয়নার সামনে দাড়িয়ে টাই বাঁধছিলো আর আমাকে শুনিয়ে একা একাই কথা বলছিলো
--কতো ইচ্ছা ছিলো বউ আমার টাই বেঁধে দেবে।ধুরর কাজের কাজ কিছুই হলোনা
-.-
-একটু পর আমার সামনে এসে দাড়ালো।
--এইযে নীলাদ্রী ম্যাডাম,আমাকে কেমন লাগছে একটু বলবেন কি?
-.-
-আমি কিছুই না বলে ব্যালকনির দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।
--আপনার কি হয়েছে?আপনি সাজুগুজু করবেননা?আপনি যদি বলেন আমি আপনাকে সাজিয়ে…
--কোন দরকার নাই।আমি নিজেই সাজতে পারি,আপনি আমার রুম থেকে যান
--তুমিতো শাড়ি পরতে পারোনা।আমি পরিয়ে দেই
--আপনি যাবেন ঘর থেকে?
--আমি কিন্তু পার্লারের মহিলাদের থেকেও বেশি সুন্দর শাড়ি পরাতে পারি
--পরাইছেন কাউকে?বিয়েকি আরও দশটা করছেন?
--তোমাকে বিয়ে করেই আক্কেল দাঁত উঠে গেছে আবার আরও দশটা?আমাদের কলেজের একটা প্রোগ্রামে আমার এক ছেলে ফ্রেন্ড কে আমি শাড়ি পরিয়ে দিয়েছিলাম।ও ছিলো নায়িকা আর আমি ছিলাম নায়ক
--আপনি নায়ক?আর কিছু বললাম না
--কোন দিক দিয়ে কম আছে?অফিসের সব মেয়ে কলিগরা আমার সাথে লাইন মারতে চাইতো তুমি জানো?তোমার সাথে বিয়ে হবার পর আমার দিকে তাকায়না পর্যন্ত এখন
--সেইজন্যেই তো একটা প্রেমও টিকিয়ে রাখতে পারেননি
--টেকা না টেকা পরের ব্যাপার।তোমায় লাইফেতো প্রেম আসেইনি।পাত্তাই পাওনি কারও কাছে
--তাইনা?শোনেন এইসব প্রেম ভালোবাসার প্রতি আমার কোন ইন্টারেস্ট নাই।আপনি এতো বড় বড় কথা বলছেন,বিয়েতো করতে চাইছেন ক্লাস টেনে পড়ুয়া বাচ্চা মেয়েটাকে ওইযে আপনার খালাতো বোনটাকে।২৬/২৭ বছরের এক বুড়া হয়ে বিয়ে করবে ১৬ বছরের বাচ্চাকে,ইয়াখ
--এইটা তোমাকেও বলা হইছে?শোনো আমি ওকে বিয়ে করতাম না।আর করতে দিলা কই?তার আগেইতো তুমি আমাকে শেষ করে দিছো
--দেখুন আমি কিন্তু বাবার ইচ্ছায়ইইইইইই…
-.-
-মুখ দিয়ে আর কোন কথা বের হচ্ছিলোনা।ঠোঁটে হাত দিয়ে খাটের উপর ধপ করে বসে পড়লাম।কেউ একজন আমার হাত ধরে উঠিয়ে দাড় করালেন।শাড়ির কুচি ঠিক করে দিয়ে শাড়ি পরিয়ে দিলেন।নিজের ইচ্ছেমতো আমাকে সাজিয়ে দিলেন,চুল আচড়ে দিলেন।তার চেহারা আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম না।সবকিছু এমন ঝাপসা দেখছি কেন?আমি কি মারা যাচ্ছি?
-.-
-অনুষ্ঠান শেষে সবাই যার যার মতো চলে গেলো।আম্মু আসেনি বলে আমার মতো বাবারও কিছুটা মন খারাপ হলো।দুহাটুতে মুখ গুঁজে খাটের উপর বসে আছি।বুক ফেটে কান্না আসছিলো আমার।ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদি।কিন্তু আমার চোখের কোণে এক ফোটা জল ও জমলোনা।আব্বু আম্মুর উপর জমে থাকা সব অভিমান অন্তিমের উপর রাগ হিসেবে ঝেঁড়ে দিয়েছি-
-.-
-শীস বাজাতে বাজাতে অন্তিম রুমে ঢুকলো।
--কি ব্যাপার?এখনো শাড়িটা বদলাওনি যে?বলছিলাম না তোমাকে কালো শাড়িতে অনেক মানাবে?
-.-
আমি কোন কথা না বলে তখনো মুখ গুঁজে আছি।
--কি হয়েছে নীল?
-.-
-আমার পাশে বসে আমার কাঁধে হাত দিতেই আমি ছিটকে সরে গেলাম।
--প্রবলেম কি আপনার?আমাকে টাচ করার সাহস হয় কিভাবে আপনার?বিয়ে করেছেন বলে কি যা খুশি তাই করবেন?সকাল একবার আমার গালে চুমু খেয়েছেন।সন্ধ্যায় কি করলেন?আবার আমার ঠোঁটে চুমু খেয়েছেন।কিছু বলিনি দেখে নিজেই শাড়ি পরিয়ে দিয়েছেন।নিজে সাজিয়ে দিয়েছেন।সবার সামনে আমার কাঁধে হাত দিয়ে ছবি তুলেছেন।আপনি বলতে চান হাজব্যান্ড হিসেবে আপনি এইসব অসভ্যতামি করতেই পারেন?না পারেননা।আমি আপনাকে হাজব্যান্ড হিসেবে মানিনা।
-নীল যা বলার আস্তে বলো।ঘরে তোমার বাবা আর আমার বাবামাও আছেন।উনারা শুনলে প্রবলেম হবে।
--কিসের প্রবলেম হ্যা?আমি সবাইকে জানিয়ে দিবো আপনার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।আমি আপনাকে হাজব্যান্ড হিসেবে মানিনা।আপনি একটা ছোটলোক,অসভ্য না না আপনি একটা লু**।খবরদার একদম আমার কাছে আসবেননা।আমি আর আপনার সাথে কোন সম্পর্ক রাখবোনা।বাবামার কথা চিন্তা করে আপনাকে বিয়ে করে আমি আমার পুরো লাইফটাই শেষ করে ফেলেছি।আর এক মুহুর্তও আপনার সাথে না।আর কোন সম্পর্ক রাখতে চাইনা আমি আপনার সাথে।আপনার চেহারাও দেখতে চাইনা।ডিভোর্স চাই আমি-
-.-
-কথাটা বলেই চুপ করে গেলাম।কি বললাম এটা আমি?আমার সামনেই অন্তিম দাড়িয়ে আছে।আমার কাছ থেকে এমন একটা কথা ও মোটেই আশা করেনি।আরও কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।ফ্লোরে বসে দেয়ালের সাথে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলাম।বুঝতে পারছি চোখ ভিজে এসেছে-
-.-
-ক্লাস,বন্ধু,আড্ডা কোথাও মন বসাতে পারছিনা।কেমন যেন জানি খালি খালি মনে হচ্ছিলো।কিছু একটা নেই মনে হচ্ছে আমার।সেদিনের পর থেকে গত একসপ্তাহ অন্তিমের সাথে আমার কোন যোগাযোগ নেই।বাসায় আসাতো দূরে থাক একটা কল ও করেনি আমাকে।ও কি তাহলে সত্যিই ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিবে?কেমন জানি ভয় ভয় লাগছিলো?আমি নিজেইতো ওর কাছে ডিভোর্স চেয়েছি তাহলে আবার ভয় পাচ্ছি কেন?-
-.-
কল লিস্ট অনেক ঘেঁটেও অন্তিমের নাম্বার খুঁজে পেলাম না।বাবার কাছ থেকে যে নাম্বার চাইবো তাও পারছিনা।বাবা সম্ভবত এখনো কিছুই জানতে পারেনি।জানতে পারলে আমাকে এতোদিনে নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করতো।
-রাতে বাবার সাথে খেতে বসেছি।বাবা বললেন -
-মন খারাপ?
-কই নাহ
অন্তিমের সাথে কথা হয়েছে
উঁহু
-ওর সাথে গেলেই পারতি
-কোথায়?
-কক্সবাজার
-অন্তিম কক্সবাজার?
-না।অফিসের একটা কাজে আমার চিটাগং যাওয়ার কথা ছিলো।কিন্তু অন্তিম নিজে থেকেই দায়িত্ব নিয়ে চলে গেলো।আমি বললাম তোকে সহ নিয়ে গিয়ে কক্সবাজার ঘুরে আসতে।তুই নাকি যাবিনা বললি?
--ও হ্যাঁ।-
-.-
বাবার ঘরে গিয়ে উনার ফোন থেকে অন্তিমের নাম্বার টা নিয়ে আসলাম।কল দিবোনা কি না বুঝতে পারছিলাম না।কল দিয়ে বলবোই বা কি।বারবার ডায়েল করে কল যাওয়ার আগেই ক্যান্সেল করে দিচ্ছি।শেষে সাহস করে দিয়েই দিলাম।
-হ্যালো
-হ্যালো ভাবী?
-অন্তরা?
-হ্যাঁ,কেমন আছেন?
-তুমি কক্সবাজার?
-নাহ,আমিতো বাড়িতে
-আর তোমার ভাইয়া?তার ফোন তোমার কাছে?
-ভাইয়াতো একটু বাইরে গেছে।তুমি ভাইয়ার সাথে আসোনাই কেন?
--আমি?আমি যেতে চেয়েছিলাম তো।আমাকে ও নেয়নি।তোমার ভাইয়া আমাকে সহ্যই করতে পারেনা তুমি তো জানোই -
-এহহ তুমি বললেই হলো নাকি?ভাইয়া তোমাকে কত্তো ভালোবাসে।ভাইয়ার মোবাইলের হোম স্ক্রিনে তোমার ছবি দেয়া,তোমাকে কি সুন্দর বউ বলে ডাকে আর তুমি কিনা?
-আমার ছবি?তুমি কিভাবে জানো আমাকে বউ বলে ডাকে?
--তোমার নাম্বার তো বউ নামেই সেইভ করা।এইতো ভাইয়া আসছে।এই নাও তোমার বউয়ের সাথে কথা বলো-
-.-
-অন্তরার কথা শুনে নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি জমা হলো।অন্তিম ফোন ধরেই হ্যালো হ্যালো করছিলো।আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছিলোনা।মনে হচ্ছে কেউ আমার গলা চেপে ধরেছে।এতোদিন পর ওর ভয়েস শুনতে পেয়ে কেমন জানি অস্থির লাগছিলো।মনে হচ্ছে ও আমার থেকে অনেক দূরে।অনেক চেষ্টা করেও মুখ দিয়ে একটা শব্দ ও বের করতে পারলাম না।কল কেটে দিলাম।আমার বারবার মনে হচ্ছিলো প্রতিবারের মতো আজও আবার কল ব্যাক করবে কিন্তু আমার ধারণা ভুল ছিলো।ফোনটা হাতে নিয়েই শুয়ে পড়লাম।মনে হয় এই বুঝি ফোনটা বেজে উঠলো।চোখ খুলে দেখি না,কোন কল আসেনি।কেন জানি আমার চোখের পাতা এখন বারবার ভিজে আসে।ও আমাকে বুঝিয়ে দিলো কারও কলের অপেক্ষায় ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকা মানেই যে তার কল আসবে এমন কথা নেই।-
-.-
রাত প্রায় তিনটা।ফোনের হালকা টিং শব্দ হওয়ার সাথে সাথেই রিসিভ করলাম।
--হ্যালো -
-হ্যালো
-হ্যালো?
-হ্যাঁ বলো
-কি বলবো?
-অন্তরা বললো কল দিয়েছিলে?কিছু বলার ছিলো?
-কই নাহ।আমি আপনাকে কল দিবো কেন?আপনার নাম্বার তো আমার ফোনে সেইভই নেই।একটা নাম্বারে ডায়াল করতে গিয়ে একটা ডিজিট ভুল হয়ে আপনার নাম্বারে চলে গেছে।
-ওহ আচ্ছা।ঠিক আছে,রাখি তাহলে
-রাখি মানে কি?এতো রাতে কল দিয়ে আমার ঘুম ভাঙানোর মানে কি?
--আচ্ছা সরি আর কখনো কল দিবোনা,বাই-
-.-
-এভাবে আমাকে কষ্ট দেয়ার মানে কি?আমি ওর জন্য কষ্টই বা পাচ্ছি কেন?আমি কি ওকে ভালোবাসি?-
-.-
-বাবার কাছ থেকে শুনলাম অন্তিম তিনদিন আগেই ঢাকায় এসেছে।অফিসে কাজের চাপ বেশি ছিলো বলে নাকি বাসায় যেতে পারেনি।ক্লাস শেষে সোজা অফিসে চলে গেলাম।আজ অন্য সবার মতো অন্তিমও আমাকে দেখে দাড়ালো।আমার দিকে একবারও তাকালোনা।কিছু না বলে সোজা বাবার রুমে চলে গেলাম।-
-.-
এতোদিন জানতাম মেয়ের মুখ দেখে কেবল তার মা'ই তার মনের কথা বুঝতে পারেন।কিন্তু কিভাবে জানি বাবা আমার মুখ দেখে আমার মনের কথা বুঝতে পেরে গেলেন।আমাকে বুঝালেন অন্তিম আমাকে যতোটা সুখে রাখবে এতো সুখে আর কেউ রাখতে পারবেনা।দেরী হলেও আমার মনে যে অন্তিম একটু একটু করে জায়গা নিয়েছে তাতেই বাবা খুশি হয়েছেন।
-স্যার আসবো?
--হ্যা আসো অন্তিম।বসো-
-.-
আমার দিকে একবার তাকিয়ে আমার পাশের চেয়ারটাতেই বসলো।
-কিছু লাগবে স্যার?
-উফফফ ঘরের সবাই একসাথে থাকলে স্যার স্যার বইলোনা।শোনো আজ বাড়িতে একটা স্পেশাল রান্না হবে।কলাপাতায় চিড়িং মাছ।আজ অফিসে যতোই কাজ থাকুক তুমি আজ বাসায় যাবাই
-না মানে কাকা অফিসের এতো কাজ ফেলে?
--আমি বলেছিনা?তোমার চিন্তা করতে হবেনা।-
-.-
-উঠে দাড়ালাম আমি।অন্তিমকে উদ্দেশ্য করে বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম -
-আমার গাড়ির ড্রাইভার আজকে ছুটিতে আছে।আমি রিক্সা নিয়েই চলে যাচ্ছি।
-রিক্সা কেন?আমার গাড়ি নিয়ে যা
-আমি তোমার গাড়িতে কখনো উঠিনা ভুলে গেছো?(বাবাকে ইশারা করে অন্তিমকে দেখিয়ে দিলাম)
ওহ হ্যা…ইয়ে অন্তিম তুমি তাইলে বাইকে করে নীলাকে বাসায় নিয়ে যাও।আজ আর আসতে হবেনা
.
অন্তিম সারা রাস্তা একটা কথাও বলেনি আমার সাথে।খুব ধীরেও না আবার দ্রুত ও না এমন ভাবে বাইক চালিয়েছে।আমি যে ওকে ধরে বসবো সেরকম বাহানাই পাচ্ছিলাম না।
.
বাবা একটু তাড়াতাড়িই খেয়ে উঠে গেলেন।অন্তিমকে অন্য আরেকটা রুমের দিকে যেতে দেখে বললাম"একবার রুমের দরজা বন্ধ করলে আমি কিন্তু আর খুলবোনা।"
.
আমাকে আসতে দেখেই ল্যাপটপ টা বন্ধ করে শুয়ে পড়লো অন্তিম।আজ আর বললোনা "কালকে তো শুক্রবার,চলো কোথাও বেড়াতে যাই"।
.
লাইট অফ করে মোবাইল টা হাতে নিয়ে আমিও শুয়ে পড়লাম।একটু পরেই অন্তিমের মোবাইলে মেসেজের টোন বেজে উঠলো।আমি ভেবেছি ও মেসেজের রিপ্লাই দিবে কিন্তু ও মুখেই উত্তর দিয়ে দিলো
-কাল শুক্রবার আমি জানি
.
আবার মেসেজ দিলাম "কালকে কি ফ্রি আছেন?"আমি ওকে মেসেজ দিচ্ছি আর ও উত্তর মুখেই দিচ্ছিলো
-হ্যাঁ ফ্রি
-মানে বলছিলাম অনেক দিন মুভি দেখতে যাইনা।কালকে যদি?
-আচ্ছা ঠিক আছে।
.
এতো তাড়াতাড়ি ও ঘুমিয়ে পড়লো!টেস্ট করে দেখা যাক ও আসলেই ঘুমুচ্ছে কিনা?ঘুমের ভান ধরে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলাম ওকে।ভেবেছি অন্তিমও আমাকে সেদিনের মতো জড়িয়ে ধরবে।নাহ,ও আস্তে করে আমাকে সরিয়ে দিলো।মেজাজ টা গরম হয়ে গেলো আমার।এহ ভদ্রতা দেখাতে আসছে আমাকে?অসভ্য একটা।ও কি বুঝতে পারছেনা আমি আর আগের মতো নেই?আবার ইচ্ছে করছে ওর সব চুল একটা একটা করে ছিড়ে ফেলি।কিন্তু কোনমতে নিজেকে শান্ত করলাম।
.
আজকের সকাল টা অন্যদিনের তুলনায় অনেক আলাদা।কেন জানি আজ সবকিছুই ভালো লাগছে।অন্তিম তখনো ঘুমুচ্ছে।ওর চুলে হাত বুলাতেই ও চোখ খুললো।আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন আমি অন্য গ্রহের প্রাণী আর আমাকে আজ প্রথম দেখছে।আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিলো।একবার হাতের কালো চুড়ির দিকে তাকায়,আরেকবার পায়ের নুপুরের দিকে তাকায়।
-এইযে,আর কতো ঘুমাবেন?
-না এইতো উঠলাম তো
-তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নেন।বাইরে যাওয়ার কথা মনে আছে?
.
রুম থেকে বের হওয়ার সময় আয়নায় দিকে তাকিয়ে দেখি ওর ঠোঁটে মুচকি হাসি লেগে আছে।
.
কোলের উপর একটা শাড়ি নিয়ে বসে আছি।ও বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিলো।বললো
-দেরী হয়ে যাচ্ছেনা?
-কিন্তু আমিতো শাড়ি পরতে পারিনা
-সালোয়ার কামিজ তো আছে
-না আমি শাড়ি পরবো
-ইউটিউবে শাড়ি পরানোর ভিডিও আছে।আমি বাইরে আছি,সাজগোজ শেষ হলে ডাক দিও।
.
কুত্তা,বিলাই,শয়তান,গুন্ডা কতো গালি দিলাম মনে মনে।বলদ একটা কিচ্ছু বুঝেনা।কল দিয়ে রুমে আসতে বললাম।
-একি এখনো শাড়ি পরা হয়নি?
-বললাম তো পারিনা?
-ইউটিউবে কি দেখছিলে এতক্ষণ
-টাই বাধা শিখছিলাম
-থাক,শাড়ি পরতে হবেনা।অন্য কোন ড্রেস
-নাহ,আমি শাড়ি না পরে যাবোনা
-কিন্তু তুমি তো শাড়ি পরতেই পারোনা
-আপনি তো পারেন।পরিয়ে দিতে
.
শাড়ি পরানোর সময় ওর চোখ বন্ধ রাখার কথা ছিলো।অথচ আমি নিজেই চোখ বন্ধ করে রেখেছিলাম।বাইকে বসার সময় ওর কাঁধে হাত রেখে বসলাম।
.
মুভির মাঝখানে রোমান্টিক সিন।কিছুদিন আগের কথা। অন্তিম সোফায় বসে টিভি দেখছিলো।আমি ও ঘরে ঢোকার সময় টিভির দিকে তাকাতেই দেখি রোমান্টিক সিন দেখাচ্ছে আর বেশ মনযোগ দিয়েই অন্তিম সেটা দেখছে।আমাকে দেখেই তাড়াতাড়ি রিমোটটা নিয়ে চ্যানেল চেঞ্জ করে বললো
-আস্তাগফিরুল্লাহ নাউজুবিল্লাহ।কিসব জিনিস পাতি দেখায় টিভিতে।এইজন্যই টিভি দেখতে চাইনা আমি।
.
অথচ আজ রোমান্টিক সিন আসার সাথে সাথেই অন্তিম এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো ।আমার সাথে একবার চোখাচোখিও হয়েছিলো।সেদিনের কথাটা মনে করে আমি হাসতে লাগলাম।ও লজ্জায় আমার দিকে আর তাকাতেই পারছিলোনা।
.
দুপুরের খাবার শেষে কিছু কেনাকাটা করলাম। একটা রিস্ট ওয়াচ কিনে ওর হাতে পড়িয়ে দেয়ার সময় বললাম "ছেলেদের হাতে ঘড়ি না থাকলে আমার কেমন জানি লাগে"
.
সূর্য প্রায় ডুবি ডুবি করছে।রাস্তায় হাটতে হাটতে বাদাম চিবুচ্চি।আমি বুঝতে পারছি ও বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছে তাই আর ওর দিকে তাকিয়ে ওকে লজ্জায় ফেলতে চাইলাম না।বললাম
-বাম হাতের ব্যাগগুলো সব ডান হাতে নেন
-কেন?
.
আমি আমার কনিষ্ঠা দিয়ে ওর কনিষ্ঠা ধরলাম।একে একে ওর সব আঙুলের ফাঁকে আমার আঙ্গুল গুলোকে জায়গা করে দিলো।আরও কিছুক্ষণ এভাবে হাটলাম।ও আমার দিকে তাকিয়ে বললো
-কি?
-ফুচকা খাবো
.
সন্ধ্যা হতেই অন্তিম বাসায় যাওয়ার কথা বললো।আমি হঠাৎ করেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।অন্তিম ও রাজি হলো আমার সিদ্ধান্তে ।অন্তিমের কথায় আম্মুকে ফোন করলাম।বিয়ের পর থেকে আমি বা আম্মু কেউ কাউকে ফোন দেইনি কখনো।বললাম "আমি আমার সংসার সামলাতে যাচ্ছি,তুমি এসে তোমার সংসার সামলাও।"আম্মু আমাকে অনেক বুঝাচ্ছিলেন যে আমি এই যুগের মেয়ে হয়ে গ্রামে সংসার করবো কেন?আমাকে একদমই মানাবেনা।আমার চুল ত্বক সব নষ্ট হয়ে যাবে।আমি শুধু বললাম "ভালোবাসার কাছে ঐসব কিছুইনা।আর তোমার জন্য তোমার ভালোবাসা অপেক্ষা করে আছে।"
.
রাত এগারোটার বাসে উঠলাম আমরা।আব্বুকে এখনো কিছুই জানাইনি।আমি জানি আব্বুকে জানালে আম্মু যতোটা নারাজ হয়েছে আব্বু ঠিক ততোটাই খুশি হবে।ফোন করে বললাম আমি আমার শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি।অন্তিমের বাবা মা যদি আমার সাথে ঢাকায় আসতে রাজি না হয় তাহলে আমিই না হয় গ্রামে থেকে যাবো।আব্বু বললেন" উনারা আসবেন,আমি বলবো আসার জন্য।" আমি বললাম তাহলে আমরা আলাদা ফ্ল্যাট নিবো।আব্বু তার একটা ফ্ল্যাটে আমাদের থাকতে বললেন কিন্তু আমি বললাম এতে আমার স্বামীর আত্নসম্মান থাকবেনা।আমার কথা শুনে বাবা কাঁদছিলেন আমি বুঝতে পারছিলাম।ফোনের এপাশ থেকে কলিংবেলের আওয়াজ শুনে বললাম
-আব্বু দরজা খোলো।দেখো কে এসেছে?
.
আমি তখনো কানের সাথে ফোন ধরে আছি।দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেলাম।আব্বু বললেন
-তুমি?এতো রাতে?একা এখানে?
-হ্যাঁ আমি,কোনো সমস্যা?ভেতরে তো যাইতে বলবা।দরজার সামনে থেকে সরো।
.
কল কেটে দিলাম।বাস চলতে শুরু করেছে।আজ নিজেকে সব থেকে সুখী মনে হচ্ছে।আমি হাসছি।সুখের হাসি।অন্তিম ওর হাত দিয়ে আমার চোখের পানি মুছিয়ে দিলো।ওর কাঁধে মাথা রাখলাম।হেডফোন বের করে আমাকে দেয়ার সময় বললাম "হেডফোন লাগবেনা আজ।পুরোটা পথ আমি তোমার কথা শুনতে শুনতে যাবো।"
.
বাসের লাইট নিভিয়ে দেয়া হয়েছে।আমার হাত অন্তিমের হাতের মুঠোয়।চোখ বন্ধ করে কপালে ওর ঠোঁটের স্পর্শ অনুভব করলাম।ওর বুকে মাথা এলিয়ে দিলাম।আমি ওর মুখ থেকে ভালোবাসি কথাটা শুনতে চাইনা।সারাজীবন ওর বুকে কান পেতে ওর হৃদয়ের কথা শুনতে চাই যার প্রতিটা স্পন্দন বলে "তোমাকে ভালোবাসি"

No comments:

Post a Comment